বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

শিশু পুত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন বিচারক

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী:

পিস্তল হাতে শিশু পুত্র। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন বিচারক পিতা। তিনি ছেলেকে শেখাচ্ছেন ট্রিগার চাপার কৌশল। ছেলেও একের পর এক গুলি ছুঁড়ছে। বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুল ইসলাম জুয়েল তার দুই শিশু পুত্রকে আগ্নেয়াস্ত্র চালনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিচারকের এক ছেলে, আনুমানিক ৭-৮ বছর বয়স হবে, জিনস আর টি শার্ট পরা। আর যে ছেলের হাতে বন্দুক ধরিয়ে পরে তাকে ট্রিগার চাপতে শেখাচ্ছেন, তার বয়স তিন/চার বছর হবে। হাফ প্যান্ট পরা। খালি গা। গুলি করলে পিস্তল যে ঝাঁকি দেয় এতোটুকু ছেলে সে ধাক্কা সহ্য করতে পারছিল না। বিচারক জাহিদুল তাই গুলি করার সময় নিয়ে পিস্তল ধরে ভারসাম্য রক্ষা করছিলেন।

ছবিটা দেখে চমকে উঠেছি। এই তথাকথিত বিচারক যদি তার শিশু পুত্রদের বৃক্ষ পরিচর্যা করতে শেখাতেন, যদি প্রকৃতির মধ্যে পশু পাখিকে যত্ন করা শেখাতেন, যদি ছবি আঁকা শেখাতেন তা হলে তাকে আমরা সাবাসি দিতে পারতাম। কিন্তু কোমলমতি শিশু পুত্রদের ভায়োলেন্স শিক্ষা দিয়ে এই বিচারক কী বিচার করলেন? আমি এই দুই শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত বোধ করছি। ঐ তথাকথিত বিচারক বলতে পারেন, মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি ভালো নয়। আমার ছেলেকে আমি ছবি আঁকা শেখাবো না বন্দুক চালনা শেখাবো, সেটা আমার ব্যাপার। আপনি তার ভেতর নাক গলাবার কে?

না, বিচারক সাহেবের জানার কথা যে, সন্তান আপনার হলেও তার ওপর আপনি কোনো নির্যাতন করতে পারেন না। এই ছোট শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া শিশু নির্যাতনের শামিল। ভিডিওটির সত্যতা বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন বিচারক জাহিদুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, অনেক আগে বেড়াতে গিয়ে শখের বসে ভিডিওটি ধারণ করা হয়। জাহিদুল জানান, তিনি যখন সুন্দরবনের কয়রা এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তখনকার ঘটনা এটি। সুন্দরবন বেড়াতে গিয়ে বাচ্চারা শখের বসে পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে। তখন এই ভিডিওটি তার ফেসবুকে আপলোড করা হয়। তবে এখন সাংবাদিকদের জেরার মুখে তিনি স্বীকর করেন যে, নৈতিকভাবে কাজটি ঠিক হয়নি। 

ষাটের দশকের শেষ দিকে আমাদের এক বন্ধু পুলিশের চাকরিতে যোগ দেয়ার জন্য নির্বাচিত হন। পুলিশ, এসবি, ডিবির লোকেরা আমাদের ঐ বন্ধুর চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি নিতে শুরু করেন। এমনকি অপরিচিত লোকেরা আমাদের সঙ্গেও তার চরিত্র, বাপ-দাদার পরিচয়, তার কোনো আত্মীয়ের অপরাধের রেকর্ড আছে কিনা, কেউ কোনোদিন জেল খেটেছে কিনা, এতসব তত্ত্ব-তালাশের পর শেষ পর্যন্ত আমাদের ঐ বন্ধুর চাকরি হয়েছিল। স্কুলের হেড মাস্টার ঐ লোকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা এমন তোলপাড় করছেন কেন? তারা জবাব দিয়েছিলেন, পুলিশের চাকরি নিয়ে এমনিতেই অনেক কথা। তাই একে চাকরি দেয়ার আগে তার পরিবারের সমস্ত ঠিকুজি দরকার।

এখনও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে নানা ধরনের ভেরিফিকেশন হয়। সেসব ভেরিফিকেশনের লক্ষ্য, সংশ্লিষ্ট চাকরি প্রার্থীর চৌদ্দ পুরুষের কেউ কোনোদিন বিএনপি করেছে কিনা, করে থাকলে অযোগ্য। চোর, বাটপার, খুনি অস্ত্রবাজ বন্দুকবাজ হলে কোনো অসুবিধা নেই, দেখতে হবে চাকরি প্রার্থী আওয়ামী পরিবারে সদস্য কিন। ব্যস হয়ে গেল। যোগ্যতা দূরে থাক। আমি জানি না, জাহিদুল ইসলাম কোন যোগ্যতায় নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক পদে আসীন হয়েছেন। তিনি বিচারক। কিন্তু এমন একজন ব্যক্তি, যিনি শিশু নির্যাতন মামলার আসামী হতে পারেন। এই জাহিদুল ইসলামের নৈতিক শিক্ষার দারুণ অভাব রয়েছে। বিচারিক পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, দলমত নির্বিশেষে সেখানে নৈতিকতার একটা মানদ- থাকা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ সবকিছু দলীয়করণ করে সে মানদণ্ড ধ্বংস করে দিয়েছে। এই অস্ত্রবাজ ম্যাজিস্ট্রেট শুধু নয়, অস্ত্রবাজির ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পরও ওই সরকার ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়  কর্তৃপক্ষ এক অস্ত্রবাজকে ঢাবিতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

সর্বত্র একই অবস্থা। অস্ত্রবাজ কিনা, নৈনিতকভাবে অধঃপতিত কিনা, সে প্রশ্ন বড় নয়, এখন সবচেয়ে বড়  যোগ্যতা সে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ করে কিনা, তার পরিবারের লোকেরা আওয়ামী লীগ কিনা। নিদেনপক্ষে বাড়ি গোপালগঞ্জ কিনা। এই যে পুলিশ ইন্সপেক্টর শেখ সোহেল রানা ই-অরেঞ্জ কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের সাড়ে ১১শ’ কোটি টাকা মেরে দিলেন। দুর্নীতির দায়ে বিএনপি আমলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার চাকরিচ্যুতির আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। কেন? দুর্নীতির দায়ে বিএনপি আমলে চাকরি গিয়েছে, অতএব, তিনি ফেরেশতার মতো সৎ লোক। বাড়ি গোপালগঞ্জ বলে বিএনপি প্রতিহিংসাবশত তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল। কিন্তু এখন কি প্রমাণিত হলো? সরকারি আশকারা পেয়ে সামান্য একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে ই-অরেঞ্জ খুলে, চতুর্থ স্ত্রীকে সামনে নিয়ে গ্রাহকের সাড়ে ১১০০ কোটি টাকা মেরে  দিয়ে দিব্যি ছিলেন শেখ সোহেল রানা। বেশ নিশ্চিন্তই ছিলেন। তার সম্পদ আছে, ক্যাসিনো হোটেল, শপিংমল আছে নেপাল, থাইল্যান্ড ফিলিপিন্সসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে। শেষ পর্যন্ত যখন দেখলেন, শেষ রক্ষা নাও হতে পারে, তখন তিনি বিনা পাসপোর্টে ভারত হয়ে নেপাল যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্যাড়াবান্ধা পোস্টে বিএসএফ তাকে আটকে দেয়। এখন তিনি ভারতীয় কারাগারে। তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনা যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ ভারত বলছে, ভারতীয় আইনে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তার বিচার হবে। বাংলাদেশ চাইছে ভারত তাকে ফিরিয়ে দিক। কিন্তু সে দিল্লী দূরঅস্ত। নিরাপদেই আছেন শেখ সোহেল রানা।

 তেমনি পরীমনির সঙ্গে অনৈতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়েছেন গোলাম সাকলায়েন। সকাল সাতটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত সাকলায়েনের ফ্ল্যাটে সময় কাটিয়েছেন পরীমনি। এমন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সাকলায়েন পরীমনির করা মামলায় বোট ক্লাবে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সাকলায়েন। সেভাবেই পরিচয় পরীমনির সঙ্গে। তারপর দ্রুত ঘনিষ্ঠতা। পরীমনির সঙ্গে সাকলায়েনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাকে অবশ্য ডিবি থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। কিন্তু তার অনৈতিক কর্মকা-ের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেছেন, সাকলায়েনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার সুযোগ নেই। 

এভাবে চলতে থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অবশ্য সর্বনাশের  আর তেমন কিছু বাকি নেই। বিচারক দুগ্ধপোষ্য শিশুকে অস্ত্র চালনা শেখাচ্ছেন, পুলিশ অফিসার পাবলিকের ১১০০ কোটি টাকা মেরে উধাও হওয়ার চেষ্টা করছেন। বাবুরা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন, পিকে  হালদারেরা সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা মেরে কানাডায় দিব্যি সুখের সংসার বেঁধেছেন, সেখানে প্রশাসন চলছে কোন হিসাবে। এখন যে ধস তা নগ্ন দলীয়করণের ফলেই হচ্ছে। সরকারকে এই অনৈতিকায় যবনিকা টানতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ